আপনি কি হাসলে আপনার দাঁতের দিকে তাকাতে লজ্জা পান? দাঁতের উপরে হলদেটে আস্তরণ, কালো দাগ বা পাথরের মতো শক্ত কিছু জমে আছে? তাহলে আপনার জন্য স্কেলিং পলিশিং হতে পারে এক দারুণ সমাধান! ভাবছেন এটা আবার কী? চলেন, আজ আমরা এই স্কেলিং পলিশিং সম্পর্কে বিস্তারিত জানব, যা আপনার দাঁতের স্বাস্থ্য এবং সৌন্দর্য দু'টোই ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
কী-টেকঅ্যাওয়েস
- পরিষ্কার দাঁত: স্কেলিং পলিশিং দাঁত থেকে পাথর ও দাগ দূর করে।
- সুস্থ মাড়ি: মাড়ির রোগ প্রতিরোধে এটি গুরুত্বপূর্ণ।
- সতেজ নিঃশ্বাস: মুখের দুর্গন্ধ কমাতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত চেকআপ: প্রতি ৬ মাস থেকে ১ বছরে একবার স্কেলিং করা ভালো।
- ব্যথামুক্ত প্রক্রিয়া: সাধারণত ব্যথাহীন এবং নিরাপদ।
- খরচ: বাংলাদেশে খরচ তুলনামূলকভাবে কম।
স্কেলিং পলিশিং কী এবং কেন করবেন?
দাঁতের স্কেলিং এবং পলিশিং দুটি ভিন্ন প্রক্রিয়া হলেও একে অপরের পরিপূরক। সহজ কথায়, স্কেলিং হলো দাঁত থেকে জমে থাকা প্লাক (এক ধরনের নরম আস্তরণ) এবং টারটার (প্লাক শক্ত হয়ে পাথরের মতো জমার পর) পরিষ্কার করা। আর পলিশিং হলো স্কেলিং করার পর দাঁতের উপরিভাগ মসৃণ করা, যাতে ভবিষ্যতে সহজে দাগ বা প্লাক না জমে।
দাঁতের পাথর বা টারটার কী?
আমরা যখন খাই, তখন খাবারের কণা এবং মুখের ব্যাকটেরিয়া মিলে দাঁতের ওপর একটি পাতলা, আঠালো আস্তরণ তৈরি করে, যাকে বলে প্লাক। যদি এই প্লাক নিয়মিত পরিষ্কার না করা হয়, তবে তা শক্ত হয়ে পাথরের মতো হয়ে যায়, যাকে টারটার বা ক্যালকুলাস বলা হয়। এই টারটার সাধারণত দাঁতের মাড়ির কাছাকাছি এবং দাঁতের মাঝখানে জমে থাকে। ব্রাশ করলেও এই টারটার সহজে দূর হয় না, আর এখান থেকেই শুরু হয় দাঁত ও মাড়ির নানা সমস্যা।
কেন স্কেলিং পলিশিং জরুরি?
দাঁতের পাথর বা টারটার শুধু দেখতে খারাপ লাগে না, এটি আপনার মুখের স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর।
মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে
অনেকেই মুখের দুর্গন্ধ সমস্যায় ভোগেন। এর অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে দাঁতে জমে থাকা টারটার এবং ব্যাকটেরিয়া। স্কেলিংয়ের মাধ্যমে এই টারটার দূর হলে মুখের দুর্গন্ধও কমে যায়।
মাড়ির রোগ প্রতিরোধে
টারটার মাড়ির প্রদাহ (জিঞ্জিভাইটিস) সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে মাড়ি ফুলে যায়, রক্তপাত হয় এবং ব্যথা করে। সময়মতো চিকিৎসা না করালে এটি পেরিওডনটাইটিস নামক আরও গুরুতর মাড়ির রোগে পরিণত হতে পারে, যা দাঁত হারানোর কারণ হতে পারে। স্কেলিং এই মাড়ির রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
দাঁতের ক্ষয় রোধে
টারটার দাঁতের ওপর একটি রুক্ষ পৃষ্ঠ তৈরি করে, যেখানে ব্যাকটেরিয়া সহজে বাসা বাঁধতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া অ্যাসিড তৈরি করে দাঁতের এনামেল ক্ষয় করে এবং দাঁতের ক্যাভিটি বা গর্ত সৃষ্টি করে। স্কেলিং দাঁতের পৃষ্ঠ পরিষ্কার করে ক্ষয় রোধে সাহায্য করে।
দাঁতকে ঝকঝকে রাখতে
স্কেলিংয়ের পর পলিশিং করলে দাঁত মসৃণ ও উজ্জ্বল হয়। এতে দাঁতের প্রাকৃতিক রঙ ফিরে আসে এবং দাঁত আরও ঝকঝকে দেখায়।
স্কেলিং পলিশিং প্রক্রিয়া
আপনার ডেন্টিস্ট সাধারণত একটি আল্ট্রাসনিক স্কেলার ব্যবহার করে স্কেলিং করে থাকেন। এই যন্ত্রটি উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে টারটার ভেঙে দেয় এবং দাঁতের পৃষ্ঠ থেকে আলতো করে সরিয়ে দেয়। এর সাথে পানি ব্যবহার করা হয় যা টারটার ধুয়ে দেয় এবং যন্ত্রকে ঠান্ডা রাখে।
স্কেলিং করতে কতক্ষণ লাগে?
সাধারণত, স্কেলিং করতে ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে দাঁতে কতটা টারটার জমেছে তার ওপর নির্ভর করে সময় কমবেশি হতে পারে।
স্কেলিং কি ব্যথাযুক্ত?
অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্কেলিং একটি ব্যথাহীন প্রক্রিয়া। তবে যদি আপনার দাঁত বা মাড়ি খুব সংবেদনশীল হয়, তাহলে সামান্য অস্বস্তি হতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার ডেন্টিস্ট লোকাল এনেস্থেশিয়া (দাঁতের মাড়ি অবশ করার ইনজেকশন) ব্যবহার করতে পারেন।
স্কেলিংয়ের পর দাঁত কি নড়ে যায়?
না, স্কেলিংয়ের পর দাঁত নড়ে যায় না। বরং টারটার জমে দাঁত নড়বড়ে হয়ে থাকলে, স্কেলিংয়ের পর মাড়ি সুস্থ হয়ে দাঁত আরও মজবুত হতে সাহায্য করে। অনেক সময় টারটার দাঁতকে একসাথে ধরে রাখে বলে মনে হতে পারে, স্কেলিংয়ের পর সেই সাপোর্ট চলে গেলে দাঁত নড়ছে মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে দাঁত নড়ে যায় না, বরং সুস্থ হয়।
স্কেলিং পলিশিং এর খরচ কেমন?
বাংলাদেশে স্কেলিং পলিশিং এর খরচ তুলনামূলকভাবে কম। এটি ডেন্টিস্টের অভিজ্ঞতা, ক্লিনিকের অবস্থান এবং ব্যবহৃত প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে।
সেবার ধরন | সম্ভাব্য খরচ (BDT) |
---|---|
সাধারণ স্কেলিং ও পলিশিং | ১০০০ – ৩০০০ টাকা |
রুট প্ল্যানিং (গভীর স্কেলিং) | ৩০০০ – ৭০০০ টাকা (প্রতি কোয়াড্র্যান্ট) |
(এই খরচগুলো আনুমানিক এবং পরিবর্তনশীল হতে পারে।)
স্কেলিং পলিশিং এর পর যত্ন
স্কেলিংয়ের পর আপনার দাঁত এবং মাড়ি কিছুটা সংবেদনশীল হতে পারে। এই সময়ে কিছু যত্ন নেওয়া জরুরি:
- ঠান্ডা-গরম খাবার: প্রথম কয়েকদিন ঠান্ডা বা গরম খাবার এড়িয়ে চলুন।
- নরম খাবার: শক্ত বা চিবিয়ে খেতে হয় এমন খাবার এড়িয়ে নরম খাবার খান।
- নিয়মিত ব্রাশ: দিনে দু'বার ফ্লুরাইডযুক্ত টুথপেস্ট দিয়ে নরম ব্রাশ ব্যবহার করে ব্রাশ করুন।
- ফ্লসিং: নিয়মিত ফ্লসিং করুন যাতে দাঁতের ফাঁকে খাবার জমে না থাকে।
- মাউথওয়াশ: ডেন্টিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিসেপটিক মাউথওয়াশ ব্যবহার করতে পারেন।
কতদিন পর পর স্কেলিং করাবেন?
সাধারণত, প্রতি ৬ মাস থেকে ১ বছরে একবার স্কেলিং পলিশিং করানো উচিত। তবে আপনার দাঁতের অবস্থা এবং ডেন্টিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী এটি ভিন্ন হতে পারে। যারা ধূমপান করেন বা যাদের মাড়ির রোগের প্রবণতা বেশি, তাদের আরও ঘন ঘন স্কেলিংয়ের প্রয়োজন হতে পারে।
FAQs: আপনার জিজ্ঞাস্য
১. স্কেলিং পলিশিং কি দাঁত সাদা করে?
স্কেলিং পলিশিং সরাসরি দাঁত সাদা করে না, তবে এটি দাঁতের উপরিভাগে জমে থাকা দাগ এবং টারটার সরিয়ে দাঁতের প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনে, ফলে দাঁতকে আরও ঝকঝকে দেখায়।
২. স্কেলিং করলে কি দাঁতের এনামেলের ক্ষতি হয়?
না, সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে একজন দক্ষ ডেন্টিস্ট দ্বারা স্কেলিং করালে দাঁতের এনামেলের কোনো ক্ষতি হয় না। বরং এটি দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য করে।
৩. গর্ভবতী অবস্থায় কি স্কেলিং করা যায়?
হ্যাঁ, গর্ভবতী অবস্থায় স্কেলিং করা নিরাপদ। গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মাড়ির প্রদাহ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, তাই এই সময় নিয়মিত দাঁতের যত্ন নেওয়া আরও জরুরি। তবে অবশ্যই আপনার ডেন্টিস্টকে আপনার গর্ভাবস্থার কথা জানাবেন।
৪. স্কেলিংয়ের পর কি রক্তপাত হতে পারে?
হ্যাঁ, স্কেলিংয়ের পর মাড়ি থেকে সামান্য রক্তপাত হতে পারে, বিশেষ করে যদি আপনার মাড়ি আগে থেকেই প্রদাহযুক্ত থাকে। এটি স্বাভাবিক এবং সাধারণত কয়েকদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
৫. স্কেলিং পলিশিং এর বিকল্প আছে কি?
টারটার পরিষ্কার করার জন্য স্কেলিং পলিশিং এর সরাসরি কোনো কার্যকর বিকল্প নেই। তবে দাঁতের উপরের হালকা দাগ দূর করতে কিছু টুথপেস্ট বা ঘরোয়া পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু সেগুলো টারটার দূর করতে পারে না।
৬. স্কেলিং না করালে কী সমস্যা হতে পারে?
স্কেলিং না করালে দাঁতে টারটার জমতে থাকে, যা থেকে মাড়ির রোগ (জিঞ্জিভাইটিস, পেরিওডনটাইটিস), দাঁতের ক্ষয়, মুখের দুর্গন্ধ এবং এক পর্যায়ে দাঁত নড়বড়ে হয়ে পড়ে যেতে পারে।
শেষ কথা
স্বাস্থ্যকর দাঁত এবং ঝলমলে হাসি ধরে রাখতে স্কেলিং পলিশিং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। নিয়মিত দাঁতের যত্ন, সঠিক ব্রাশ করার অভ্যাস এবং সময়মতো ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে স্কেলিং পলিশিং করিয়ে আপনি আপনার দাঁতকে রাখতে পারেন সুস্থ ও সুন্দর। তাই দেরি না করে আজই আপনার কাছের ডেন্টিস্টের সাথে কথা বলুন এবং আপনার দাঁতের যত্ন নিন! কারণ, হাসিই আপনার ব্যক্তিত্বের অন্যতম প্রধান পরিচায়ক।