শরীরের কোনো একটা অংশ অবশ হয়ে যাওয়া, ঝিনঝিন করা অথবা অনুভূতি কমে যাওয়া – এই সমস্যাগুলো কিন্তু বেশ ভোগান্তির। হয়তো রাতে ঘুমিয়ে আছেন, হঠাৎ করে হাত অবশ! অথবা একটানা ল্যাপটপে কাজ করতে করতে হাতের আঙুলগুলো যেন অসাড় হয়ে গেল। এমন পরিস্থিতিতে পড়লে একটু ভয় লাগা স্বাভাবিক। তখন আমাদের প্রথম চিন্তা হয়, “হাত অবশ হলে কোন ডাক্তার দেখাবো?”
আসলে, হাত অবশ হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তাই একজন ভালো ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াটা খুবই জরুরি। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে আপনি সঠিক সময়ে সঠিক ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন।
হাত অবশ হওয়ার কারণগুলো কী কী?
হাত অবশ হওয়ার কারণগুলো বিভিন্ন হতে পারে, কয়েকটি প্রধান কারণ আলোচনা করা হলো:
- কার্পাল টানেল সিনড্রোম (Carpal Tunnel Syndrome): এটি হাত অবশ হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ। আমাদের হাতের কব্জির মধ্যে দিয়ে “মিডিয়ান নার্ভ” নামের একটি স্নায়ু যায়। এই স্নায়ুটির ওপর চাপ পড়লে হাত ও আঙুল অবশ হয়ে যেতে পারে।
- সার্ভিক্যাল স্পন্ডিলোসিস (Cervical Spondylosis): আমাদের ঘাড়ের হাড়ের মধ্যে যদি কোনো সমস্যা হয়, যেমন হাড়ের ক্ষয় বা স্থানচ্যুতি, তাহলে হাতের স্নায়ুর ওপর চাপ পড়তে পারে। এর ফলে হাত, বাহু এবং আঙুলে ব্যথা ও অবশ ভাব হতে পারে।
- পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি (Peripheral Neuropathy): ডায়াবেটিস, ভিটামিন বি-এর অভাব, বা অন্য কোনো কারণে যদি পেরিফেরাল নার্ভগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে হাত-পা অবশ হতে পারে।
- স্ট্রোক (Stroke): মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে গেলে বা বন্ধ হয়ে গেলে স্ট্রোক হয়। স্ট্রোকের কারণে শরীরের এক পাশ দুর্বল বা অবশ হয়ে যেতে পারে।
- অন্যান্য কারণ: এছাড়াও টিউমার, সংক্রমণ, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (Multiple Sclerosis) বা থাইরয়েডের সমস্যার কারণেও হাত অবশ হতে পারে।
হাত অবশ হলে কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
হাত অবশ হলে আপনি মূলত দুই ধরনের ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন:
- নিউরোলোজিস্ট (Neurologist): স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ।
- অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ (Orthopedic Specialist): হাড়জোড় বিশেষজ্ঞ।
এখন প্রশ্ন হলো, কখন কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন? সেটা বোঝার জন্য, আপনার সমস্যার ধরনটা একটু বুঝতে হবে।
নিউরোলোজিস্টের কাছে কখন যাবেন?
যদি আপনার হাত অবশ হওয়ার সাথে সাথে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো থাকে, তাহলে দ্রুত নিউরোলোজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
- শরীরের অন্য কোনো অংশেও অবশ ভাব বা দুর্বলতা।
- কথা বলতে সমস্যা হওয়া।
- দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া।
- মাথা ঘোরা বা ভারসাম্য হারাতে সমস্যা হওয়া।
- খিঁচুনি হওয়া।
- স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া।
এই লক্ষণগুলো স্ট্রোক বা অন্য কোনো গুরুতর স্নায়ুরোগের ইঙ্গিত হতে পারে। নিউরোলোজিস্ট আপনার স্নায়ু পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করতে পারবেন এবং সঠিক চিকিৎসা দিতে পারবেন।
অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞের কাছে কখন যাবেন?
যদি আপনার হাত অবশ হওয়ার সাথে সাথে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো থাকে, তাহলে অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
- হাতে বা কব্জিতে ব্যথা।
- আঘাতের কারণে হাত অবশ হওয়া।
- ঘাড় বা পিঠে ব্যথা।
- আঙুল নাড়াতে সমস্যা হওয়া।
- হাত বা আঙুলে ফোলা ভাব।
এই লক্ষণগুলো কার্পাল টানেল সিনড্রোম বা সার্ভিক্যাল স্পন্ডিলোসিসের কারণে হতে পারে। অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ আপনার হাড়, জোড় এবং মাংসপেশী পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করতে পারবেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে পারবেন।
রোগ নির্ণয়ের জন্য কী কী পরীক্ষা করা হতে পারে?
ডাক্তার আপনার লক্ষণগুলো শুনে এবং শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করবেন। কিছু ক্ষেত্রে, রোগ নিশ্চিত করার জন্য কিছু পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে:
- নার্ভ কন্ডাকশন স্টাডি (Nerve Conduction Study): এই পরীক্ষার মাধ্যমে স্নায়ু কত ভালোভাবে কাজ করছে, তা দেখা হয়।
- ইলেক্ট্রোমায়োগ্রাফি (Electromyography বা EMG): এই পরীক্ষার মাধ্যমে মাংসপেশীর কার্যকলাপ পরিমাপ করা হয়।
- এমআরআই (MRI): মেরুদণ্ড বা মস্তিষ্কের ছবি তোলার জন্য এমআরআই করা যেতে পারে।
- রক্ত পরীক্ষা: ডায়াবেটিস, ভিটামিনের অভাব বা অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা আছে কিনা, তা জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা যেতে পারে।
হাত অবশ হলে ঘরোয়াভাবে কী করতে পারেন?
ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে, আপনি কিছু ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করে দেখতে পারেন। এগুলো হয়তো আপনার অস্বস্তি কিছুটা কমাতে সাহায্য করবে:
- বিশ্রাম: হাতকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিন। একটানা কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।
- বরফ বা গরম সেঁক: ব্যথার জায়গায় ১৫-২০ মিনিটের জন্য বরফ বা গরম সেঁক দিন।
- স্ট্রেচিং ও ব্যায়াম: হাতের কিছু হালকা স্ট্রেচিং ও ব্যায়াম করুন। এতে রক্ত চলাচল বাড়বে এবং নার্ভের ওপর চাপ কমবে।
- সঠিক ভঙ্গি: বসার বা কাজ করার সময় সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখুন। মেরুদণ্ড সোজা রাখুন এবং কাঁধ শিথিল রাখুন।
- কব্জিবন্ধনী (Wrist Brace): কার্পাল টানেল সিনড্রোমের কারণে হাত অবশ হলে কব্জিবন্ধনী ব্যবহার করতে পারেন।
হাত অবশ হওয়া থেকে বাঁচতে কী করবেন?
কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে হাত অবশ হওয়ার ঝুঁকি কমানো যায়:
- নিয়মিত ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীরের রক্ত চলাচল ভালো থাকে এবং স্নায়ুগুলো সচল থাকে।
- সুষম খাবার: ভিটামিন ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। বিশেষ করে ভিটামিন বি-এর অভাব পূরণ করুন।
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
- সঠিক ভঙ্গি: বসার ও কাজ করার সময় সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখুন।
- ধূমপান পরিহার: ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং এটি রক্তনালীগুলোকে সংকুচিত করে রক্ত চলাচল কমিয়ে দেয়।
অতিরিক্ত কিছু টিপস
এখানে কিছু অতিরিক্ত টিপস দেওয়া হলো, যা আপনার কাজে লাগতে পারে:
- কম্পিউটারে কাজ করার সময় প্রতি ২০-৩০ মিনিটে বিরতি নিন এবং হাত ও আঙুলগুলো প্রসারিত করুন।
- ভারী জিনিস তোলার সময় সাবধান থাকুন এবং সঠিক কৌশল অবলম্বন করুন।
- রাতে ঘুমানোর সময় হাত সোজা রাখার চেষ্টা করুন।
- যদি আপনি কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজান বা অন্য কোনো কাজ করেন যেখানে হাতের পুনরাবৃত্তিমূলক মুভমেন্ট (Repetitive Movement) হয়, তাহলে নিয়মিত বিরতি নিন।
হাত অবশ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
এখানে হাত অবশ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
প্রশ্ন: রাতে শোয়ার পরে হাত অবশ হয়ে যায়, এর কারণ কী?
উত্তর: রাতে শোয়ার পরে হাত অবশ হওয়ার প্রধান কারণ হলো কার্পাল টানেল সিনড্রোম। ঘুমের সময় হাতের অবস্থান ঠিক না থাকার কারণেও এমন হতে পারে।
প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় হাত অবশ হওয়ার কারণ কী?
উত্তর: গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনের পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত ফ্লুইডের কারণে নার্ভের ওপর চাপ পড়তে পারে, যার ফলে হাত অবশ হতে পারে।
প্রশ্ন: হাত অবশ হলে কি মালিশ করা উচিত?
উত্তর: হালকা মালিশ করলে রক্ত চলাচল বাড়ে এবং সাময়িক আরাম পাওয়া যায়। তবে অতিরিক্ত মালিশ করা উচিত নয়, কারণ এতে নার্ভের ওপর আরও চাপ পড়তে পারে।
প্রশ্ন: কোন ভিটামিনের অভাবে হাত অবশ হয়?
উত্তর: ভিটামিন বি-এর অভাবে (বিশেষ করে ভিটামিন বি1, বি6, এবং বি12) হাত অবশ হতে পারে।
প্রশ্ন: হাত অবশ হলে কি ব্যায়াম করা উচিত?
উত্তর: হালকা স্ট্রেচিং ও ব্যায়াম করা উপকারী, তবে অতিরিক্ত ব্যায়াম করা উচিত নয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম করাই ভালো।
প্রশ্ন: হাত অবশ হলে কি গরম সেঁক দেওয়া যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, গরম সেঁক দিলে মাংসপেশী শিথিল হয় এবং রক্ত চলাচল বাড়ে, যা সাময়িক আরাম দিতে পারে।
প্রশ্ন: হাত অবশ এবং ঝিনঝিন করার মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: হাত অবশ মানে হলো অনুভূতি কমে যাওয়া বা অসাড় লাগা। আর ঝিনঝিন করা মানে হলো সূঁচ ফোটানোর মতো অনুভূতি হওয়া। দুটোই নার্ভের সমস্যার কারণে হতে পারে।
প্রশ্ন: হাত অবশ হলে তাৎক্ষণিক কী করা উচিত?
উত্তর: তাৎক্ষণিকভাবে হাতকে বিশ্রাম দিন, হালকা স্ট্রেচিং করুন এবং বরফ বা গরম সেঁক দিন। যদি সমস্যা না কমে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
প্রশ্ন: হাত অবশ হওয়ার সাথে কি মাথা ব্যথা হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে সার্ভিক্যাল স্পন্ডিলোসিসের কারণে হাত অবশ হওয়ার সাথে মাথা ব্যথাও হতে পারে।
প্রশ্ন: হাত অবশ হলে কখন জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত?
উত্তর: যদি হাত অবশ হওয়ার সাথে সাথে শরীরের অন্য কোনো অংশে দুর্বলতা, কথা বলতে সমস্যা, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া বা খিঁচুনি হয়, তাহলে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
শেষ কথা
হাত অবশ হওয়া একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, এর কারণ অনেক কিছু হতে পারে। তাই অবহেলা না করে সঠিক সময়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই ব্লগ পোস্টে আমরা হাত অবশ হলে কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন, কখন যাবেন এবং কী কী ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করতে পারেন সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
যদি আপনার হাত অবশ হওয়ার সমস্যা থাকে, তাহলে দ্রুত একজন নিউরোলোজিস্ট বা অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন!
যদি আপনার এই বিষয়ে আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আপনার যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সবসময় প্রস্তুত।